বাংলাদেশের আইটি শিল্প প্রায় এক দশক ধরেই দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। তবে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই শিল্পটিকে বেশ কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, নিম্নমুখী বিদেশি অর্থায়ন, ডলার রেটের তারতম্য, আইটি রফতানি হ্রাস পাওয়া এবং কর অব্যাহতি সুবিধা -এই ৫ টি প্রধান বিষয় বাংলাদেশের আইটি শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এই ব্লগে আমরা এই ৫ টি চ্যালেঞ্জের বিস্তারিত আলোচনা করব এবং জানব যে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এগুলো কীভাবে বাংলাদেশের আইটি শিল্পকে প্রভাবিত করতে পারে।
উর্ধমুখী মূল্যস্ফীতি
গত বছরের (২০২৩) মার্চ মাস থেকেই বাংলাদেশ ৯% এর উপরে সাধারণ মুদ্রাস্ফীতির সাথে লড়াই করছে। তারই ধারাবাহিকতায় আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার মাত্র ১ মাস আগে, দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার গত সাত মাসের সর্বোচ্চ ৯.৮৯% এ পৌঁছেছে। গত বছরের (২০২৩) অক্টোবর মাসের পর (মুদ্রাস্ফীতি হার ৯.৯৩%) এটিই হচ্ছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম, সফ্টওয়্যার এবং অন্যান্য ইনপুটের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আইটি কোম্পানিগুলোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া মুদ্রাস্ফীতির কারণে জীবিকা-নির্বাহের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষ আইটি পেশাদারদের বেতন বৃদ্ধির জন্য চাপ বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি এভাবে চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডলার রেটের তারতম্য
গত ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার রেট ১১৭ টাকা নির্ধারণ করলেও আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ, ভর্তুকি ও প্রকল্প ব্যয়ের বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিনিময় হার ১১০ টাকা দরে হিসাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাজেট হিসাবে ডলারের রেটের এই বিপুল ফারাক ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট প্রদানে হিসাব এলোমেলো করে দিতে পারে।
আইটি কোম্পানিগুলো তাদের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশি মুদ্রায় আয় করে। বাজেটে ডলারের রেট নির্ধারণের এই পার্থক্য বাংলাদেশের আইটি শিল্পে বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রকল্প ব্যয়ের বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে ডলারের রেট কম হিসাব করা হলে আইটি কোম্পানিগুলোর আয় টাকায় রূপান্তরের সময় কমে যাবে, যার ফলে তাদের মুনাফা কমবে।
এছাড়া, আইটি কোম্পানিগুলোকে অনেক সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার এবং অন্যান্য উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার রেট বেশি হলে এইসব জিনিসের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে, যার ফলে তাদের খরচ বৃদ্ধি পাবে।
আইটি রফতানি হ্রাস
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতে রফতানি আয় ২.৩৩ শতাংশ কমে ৪০৭.০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগের একই সময়ে এই খাত থেকে রফতানি আয় ছিল ৪১৬.৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এর মধ্যে সফটওয়ার রফতানি ২৫ শতাংশ কমে ২৮.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং কম্পিউটার সেবা ৪৫ শতাংশ কমে ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। রফতানি আয়ে এমন হ্রাস হতে থাকলে আইটি কোম্পানিগুলোর আয় ও প্রসারের ক্ষমতা কমে যাবে।এর ফলে তারা কর্মী ছাঁটাই করতে বা নতুন নিয়োগ বন্ধ করতে পারে।
এছাড়া, রফতানি আয় কমতে থাকলে আইটি কোম্পানিগুলিকে গবেষণা ও উন্নয়নে কম বিনিয়োগ করতে হবে। ফলে বাংলাদেশের আইটি কোম্পানিগুলোর জন্য বিদেশী বাজারে প্রতিযোগিতা করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
নিম্নমুখী বিদেশি অর্থায়ন
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার রেটের তারতম্য এবং রপ্তানি হ্রাসের প্রভাবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদেশি ঋণ পায়নি সরকার। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায়– নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নিট বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ১১ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা কমিয়ে প্রাক্কলন করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদেশি ঋণ না পাওয়ায় – বাজেট ঘাটতির পরিমাণ টাকার অংক ও জিডিপির অনুপাত – উভয় দিক থেকেই কমবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিদেশি অর্থায়ন কমে যাওয়াকে বাংলাদেশের আইটি শিল্পের অব্যাহত প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখছে আইটি এক্সপার্টরা। তারা মনে করছে বিদেশি অর্থায়ন কমে গেলে আইটি কোম্পানিগুলো সম্প্রসারণ ও উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ জোগাড় করতে সমস্যার সম্মুখীন হবে। এছাড়াও, আইটি শিল্পে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ এবং শিল্পের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হবে। ফলে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
বিশেষ করে, নতুন স্টার্টআপগুলো যারা স্বভাবতই ব্যবসা শুরু করতে এবং চালু রাখতে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের উপর নির্ভর করে, তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও বৃদ্ধি করতে বাধার সম্মুখীন হবে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে আইটি শিল্পে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসবে।
কর অব্যাহতি সুবিধা
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) পরিষেবায় কর অব্যাহতির ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্তমানে (২০২৩-২৪ অর্থবছরে) যেখানে ২৭টি খাতে কর অব্যাহতি প্রযোজ্য, নতুন বাজেটে (২০২৪-২৫ অর্থবছরে) তা কমিয়ে ১৯টি খাতে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। তবে, একই সাথে নতুন করে আরও চারটি খাতকে এই সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে।
বাদ পড়া খাতগুলির মধ্যে রয়েছে:
- দেশব্যাপী টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক
- আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং
- ওয়েবসাইট হোস্টিং
- বিদেশি মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন
- সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন পরিষেবা
- ক্লাউড পরিষেবা
- সিস্টেম ইন্টারোগেশন
নতুন করে চারটি খাতকে কর অব্যাহতির আওতায় আনা হচ্ছে:
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক সল্যুশন ডেভেলপমেন্ট
- ব্লকচেইন ভিত্তিক সল্যুশন ডেভেলপমেন্ট
- সফটওয়্যার পরিষেবা
- ডেটা বিজ্ঞান ও ডিজিটাল তথ্য বিশ্লেষণ
এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি সক্ষম পরিষেবা খাত (আইটিইএস)-এর উদ্যোক্তারা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত তিন বছরের জন্য কর ছাড় পাবেন।
কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত খাত হ্রাসের ফলে কিছু আইটি কোম্পানির উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে আইটিইএস সহ নতুন যে খাতগুলিকে কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, সেই খাতগুলোর দ্রুত প্রসার ও উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করছে আইটি এক্সপার্টরা।