১৮৯৩ সালে ক্যালেব ব্র্যাডহাম নামের ভদ্রলোক একটি কার্বনেটেড কোমল পানীয় উৎপাদন করেন। যা ‘ব্র্যাডস ড্রিংক’ নামে তখনকার সময়ে বাজারজাত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৮৯৮ সালে তা পেপসিকোলা নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে পেপসিকো কোম্পানি এই পানীয়টির উৎপাদক। জানেন কি, এই সাধারণ কোমল পানীয়টি একসময় হয়ে উঠেছিল মিলিটারি সরঞ্জাম বিনিময়ের মাধ্যম। হ্যাঁ, ইতিহাসের এক পর্যায়ে, রাশিয়ানরা তাই করেছিল। তবে ঠিক কী কারণে তার এমনটা করেছিল?
রাশিয়ানরা পেপসি চিনলো যেভাবে
১৯৫৯ সালের দিকে প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) পরীক্ষার মাত্র দুই বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই নিজেদের পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ এবং পুনর্মূল্যায়ন করতে মস্কোতে অনুষ্ঠিত আমেরিকান জাতীয় প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিল। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভও উপস্থিত ছিলেন সেই প্রদর্শনীতে। বিশ্বে তখন চলছিল পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের রেষারেষি। তাই এই প্রদর্শনীর মুখ্য উদ্দেশ্যের পাশাপাশি ছিল আরেকটি গৌণ উদ্দেশ্য। আর তা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিকদের আমেরিকান পুঁজিবাদী সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ফলে প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিল ডিজনি এবং পেপসির মতো বড় বড় আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলোও। সেখানেই কথাবার্তার ফাঁকে দুই পক্ষের মধ্যকার বাক বিতন্ডতা শুরু হলে তা সামলানোর চেষ্টা করেন পেপসির কর্মকর্তা কেন্ডাল। তিনি ক্রুশ্চেভকে পান করতে দেন পেপসি নামের কার্বোনেটেড মিষ্টি পানীয়টি, আর তৎক্ষণাৎ প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভের তা ভালো লেগে যায় এবং নিজ দেশে পণ্যটি আমদানি করতে চান। এর আগে আদর্শিক মতভেদের কারণে দেশটিতে কোনো আমেরিকান পণ্য রপ্তানি করা হত না। সোভিয়েত নেতা পানীয়টি এতোই পছন্দ করেছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নে শেষ পর্যন্ত প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। এভাবেই পেপসি সোভিয়েত ইউনিয়নে বিক্রি হওয়া প্রথম পশ্চিমা পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
পেপসির সফল মার্কেটিং স্টান্ট
বলা হয়ে থাকে নিক্সন এবং ক্রুশ্চেভের মধ্যে তর্কটি আসলে পরিকল্পিত ছিল। এর পেছনে মূলহোতা ছিলেন ডোনাল্ড ম্যাকিনটোশ কেন্ডাল। সেদিন প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন তিনিও। তিনি যেন প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভ থেকে পণ্য রপ্তানির অনুমতি পান তাই করা হয় এই তর্কনাটক, এমনটাই ধারণা করা হয়। এরপর থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত কোকাকোলাকে টপকিয়ে পেপসি একচেটিয়া সোভিয়েত বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে।
কেন্ডাল এবং নিক্সনের গেরিলা স্টান্টের তের বছর পর ১৯৭২ সালে, পেপসি রাশিয়ায় তার প্রথম বোতলজাতকরণ সুবিধা চালু করেছিল, যেটিকে কেন্ডাল ‘বিশ্বের সেরা এবং আধুনিক পেপসিকো প্ল্যান্ট’ বলে অভিহিত করেছিলেন। পণ্য রপ্তানির অনুমতি পেলেও রয়ে গেল ছোট্ট একটি সমস্যা। রাশিয়ান রুবেল সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে ছিল মূল্যহীন। তাই পেপসি এবং সোভিয়েত সরকারকে বেছে নিতে হয়েছিল পুরানো আমলের বিনিময় প্রথাকে।
পেপসির বিনিময়ে রাশিয়া আমেরিকাকে দিবে ভদকা। তখন ভদকা ছিল সরকারি মালিকানাধীন এবং সোভিয়েতরা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করত। একই সময়ে, এটি পেপসিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্টোলিচনায়া ভদকার একচেটিয়া আমদানিকারক হিসাবে অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় বাজারে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। পেপসিই একমাত্র আমেরিকান কোম্পানি যেটি ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত টিভিতে প্রথমবারের মত বিজ্ঞাপন দেয়।
দ্যা পেপসি নেভি
সোভিয়েত বাজারে পেপসি এতোটাই ব্যবসা সফল ছিল যে আশির দশকের শেষে বছরে তিন বিলিয়নেরও বেশি বিক্রয় ছিল কোম্পানিটির। কিন্তু পেপসির বিপরীতে আমেরিকান বাজারে আমদানিকৃত ভদকার চাহিদা তেমন একটা বাড়ছিল না। তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাজারে নতুন পেপসির সাপ্লাই প্রবেশ করবে কিভাবে? তখন বেশ অন্যরকম চুক্তির প্রস্তাব আসে রাশিয়ার পক্ষ থেকে। বিশ্ব বাজারে তখন ভদকার তেমন চাহিদা না থাকলেও, অন্য একটা জিনিসের চাহিদা ছিল তখন বেশ চাঙ্গা। সেটি হলো সামরিক অস্ত্র! তাই নতুন চুক্তিতে পেপসিকে অফার করা হয়, যেখানে সোভিয়েত সরকার ১৭টি সাবমেরিন, একটি ক্রুজার, একটি ফ্রিগেট এবং একটি ডেস্ট্রয়ারের বিনিময়ে তিন বিলিয়ন সমমূল্যের পেপসির সাপ্লাই সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করতে দিবে। অন্য কোন বিকল্প না থাকায় এবং এই লাভজনক বাজার হারাতে না চাওয়ায়, পেপসি চুক্তিটি গ্রহণ করে। এই ঐতিহাসিক চুক্তি সাথে সাথেই পেপসিকে তৎকালীন বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছিল!
এই বিশাল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তখন কী করেছিল পেপসি?
সুইডিশ এক কোম্পানির কাছে শেষ পর্যন্ত পুরো বহরটি বিক্রি করে দেয় পেপসি।
পেপসির এই সোভিয়েত বাজারে ঢোকাকে বিশ্বের প্রথম দিকের এবং সবচেয়ে সফল গেরিলা মার্কেটিংগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম ধরা হয়। তা কেমন লেগেছে পেপসির সোভিয়েত ইউনিয়নের বাজার দখলের এই অন্যরকম গল্পটি? জানাতে ভুলবেন না।