
বোম্বে সুইটসঃ পটেটো ক্রাকার্স ও নস্টালজিয়া
চা দোকান থেকে সুপার শপ, অলি থেকে গলি কিংবা বাস বা ট্রেন যাত্রায় সব জায়গাতেই স্ন্যাক্স জাতীয় খাবারে সবথেকে পরিচিত মুখ পটেটো ক্র্যাকার্স কিংবা চানাচুর ভাজা। ছোট ছোট ক্ষিদা মেটাতে বা সন্ধ্যার চা-চক্রে মুচমুচে চিপ্স বা মুড়ি- চানাচুর না হলে যেন আসর জমতেই চায় না। ৯০এর দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় সকলের পছন্দের এই স্ন্যাক্স আইটেমগুলো যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। আর সেই নিত্যদিনের সঙ্গী নির্বাচনে শুরুতেই যে নাম, স্বাদ এবং চেহারা ভেসে উঠে তার নাম বোম্বে সুইটসের পটেটো ক্রাকার্স অথবা বোম্বে সুইটস চানাচুর। তবে পটেটো ক্র্যাকার্সের বাজারে বোম্বে সুইটস ই এর একমাত্র পরিবেশক প্রতিষ্ঠান নয়। বাংলাদেশে প্রান, রুচি, বিডি ফুড, ইস্পাহানি সহ আর অনেক ব্র্যান্ড ই আছে যারা দেখতে হুবহু একই প্যাকেজিং এর পটেটো ক্রাকার্স বিক্রি করছে, তবুও বোম্বে সুইটসের প্রোডাক্টই বাকি কোম্পানি গুলোর বাজারে এগিয়ে রয়েছে এবং দীর্ঘ দিন ধরে মার্কেট লিড করছে। তবে শুধু ক্রাকার্স বা চানাচুরের মার্কেটেই বোম্বে সুইটস সীমাবদ্ধ নয়, তাদের আরও রয়েছে বেভারেজ, স্পাইসেস, ফ্রোজেন ফুড এবং ফ্রোজেন পাস্তার মত আইটেম। এছাড়া দেশের বাহিরে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মোট ৩৪টি দেশে রপ্তানি হয় বোম্বে সুইটসের পন্য।
এত শত প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের শত শত পন্যের ভিড়ে কিভাবে বোম্বে সুইটস এর পটেটো ক্রাকার্স এবং অন্যান্য পন্যগুলো এখন পর্যন্ত টিকে আছে তা নিয়েই আজকের আলোচনা-
পটেটো চিপ্স এবং অতীত ইতিহাস

পটেটো চিপ্সের উদ্ভাবনের ইতিহাসটা একটু মজারই বটে। সেটা জানার জন্য আমাদের চলে যেতে হবে ১৯৫৩ সালের ৫ই জুন। নিউইয়র্কের শেফ জর্জ ক্রাম তার কাস্স্টমারকে আলু ভাজা পরিবেশন করলে তা বেশ মোটা হয়ে যাওয়ায় কাস্টমার কর্ণলিয়াস ভ্যানন্ডারবিল্ট তা ফেরত পাঠান। ফলশ্রুতিতে রেগেমেগে জর্জ একদম পাতলা করে আলু ভেজে দেন তাকে এবং সেই থেকেই জন্ম আজকের এই আলুর চিপ্সের। বলে রাখা ভালো পটেটো চিপ্স এবং ক্রাকার্স দুটো কিন্তু একি ধরণের খাবার নয়। চিপ্স হল যা সরাসরি আলুর তৈরি এবং ক্র্যাকার্স হল যেখানে আলু মূল উপকরন হলেও তাতে থাকে স্টার্চ, অন্যান্য মশলা ও ময়দা জাতীয় উপকরন। কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্রেতাই জানেন না এই দুইয়ের ভেতরকার পার্থক্যের ব্যাপারটি।
সে যাই হোক, এই তো গেল নিউইয়র্কের আলুর চিপ্স উদ্ভাবনের গল্প। বাংলাদেশে এই আলুর চিপ্স বা পটেটো ক্রাকার্স সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পেছনের কারিগর হল বোম্বে সুইটস কোম্পানিটি । ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার নওয়াবপুরের এক লেইনে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিটির মালিক মিস্টার সেলিম জিভানি। মিষ্টির প্রতি ভালবাসা থেকেই ছোট ব্যবসা শুরু করেন যেখানে পাওয়া যেত লাড্ডু, বরফি বা রসগোল্লার সহ বয়ামে ভরা চানাচুর। সেরা কোয়ালিটি এবং দুর্দান্ত স্বাদের কারনেই নওয়াবপুরেরে এই ছোট্ট দোকানটির আস্তে আস্তে প্রসার ছড়িয়ে পড়ে এবং অল্পদিনেই বেশ ভালো জনপ্রিয়তা লাভ করে বোম্বে সুইটস। বর্তমানেও যেটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কঞ্জ্যুমার ব্র্যান্ড। এখন বাংলাদেশে শুধু চিপস মার্কেটেরই ভ্যালু ৬৫০ কোটি টাকার যেখানে সবচেয়ে বেশি পরিমান বাজার শেয়ার দখল করে আছে বোম্বে সুইটস যা প্রায় ৫০ শতাংশ এবং প্রানের রয়েছে ২০ শতাংশ। ৫০’র দশকে চানাচুর আর মিষ্টির যথেষ্ট বাজার চাহিদা থাকলেও কোম্পানিটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চানাচুর উথপাদনসহ তাদের প্রোডাক্ট লাইনে ভিন্নরকম বেভারেজ এবং বেকড সুইটস আনার চিন্তা করছিল যা ১৯৭১ সালে দেশভাগের পর থেকে পুরোদমে বাস্তবায়ন শুরু হয়।
শুরু থেকেই নতুন নতুন পন্য উদ্ভাবন করে তা বাজারে পরিচিত করাই কোম্পানিটির মূলনীতি যা বজায় রেখেই ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম তারা বাজারে আনে ‘রিং চিপ্স’। পরবর্তীতে যথাক্রমে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে বাজারে আসে ‘পটেটো ক্রাকার্স’ এবং ‘মিস্টার টুইস্ট’। প্রথমে ৫ টাকা, ৮ টাকা, ১০ এবং সর্বশেষ ১৫ টাকা দামের সেই এক একটি সবুজ-লাল প্যাকেট যেন আমাদের ছেলেবেলার গল্প বয়ে বেড়াচ্ছে এখন অব্দি। পটেটো ক্রাকার্স এবং মিস্টার টুইস্ট ছাড়াও পটেটো স্টিকস, আলুজ, কর্ণটোস, নাচোস, চিলি চিপ্স নামে বিভিন্ন ফ্লেভারের চিপ্স বাজারে আনছে প্রতিষ্ঠানটি।
কেন বোম্বে সুইটস এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে?

বাংলাদেশের স্ন্যাক্স আইটেমের ভেতর শুধু চিপ্স সেগমেন্টের দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় সেখানে আছে হাজার ভ্যারাইটি এবং নামীদামী প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রান, ইস্পাহানি, স্কয়ার, , বিডিফুডস, মেরিডিয়ান, আকিজ গ্রুপ, কাশেম ফুডস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানেরও আছে পটেটো ক্র্যাকার্স সহ বেশ কিছু ভিন্ন রকম পন্য যেমন পপার্স, চিজি পাফস, ক্রস্পি কার্ল, সান চিপ্স, মেরিডিয়ান চিপ্স, কুড়কুড়ে রবং পাশাপাশি আছে বিদেশী চিপ্স ব্র্যান্ড যেমন লেইস, প্রিংগেলস ইত্যাদি। শুধুমাত্র প্রান কোম্পানিরই একাধিক ক্রাকার্স রয়েছে। এত ভ্যারাইটি কে পেছনে ফেলে কঞ্জ্যুমার আস্থা ও স্বাদ নিশ্চিত করতে বোম্বে সুইটসের পটেটো ক্রাকার্স এবং মিস্টার টুইস্ট এগিয়ে। ২০১৭ সালে রিটেইলারস সার্ভের এক রিপোর্ট মতে বাংলাদেশে ১০ টির বেশি নামে ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন নামে বিভিন্ন ব্রান্ডের ক্রাকার্স থাকলেও ৫৯% জায়গা দখল করে নিয়েছে বোম্বে সুইটস। তাছাড়া প্রতি ১০০ জনে ৩৫ জন ই বিভিন্ন ক্যাটাগরির চিপ্সের ভেতর পটেটো ক্রাকার্সকেই পছন্দের স্ন্যাক্স হিসেবে বেছে নেয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশি স্ন্যাক্স ফুড মার্কেটের ভ্যালু ছিলো ৭৪৯ মিলিয়ন ডলার যার ৩৫% ই ছিল পটেটো চিপ্সের দখলে। এছাড়া বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬১.৮২% গ্রামাঞ্চল ও তুলনামুলক শহর থেকে বিছিন্ন এলাকায় বসবাস করে ফলে সেখানটায় সব ব্রান্ডের চিপ্স ক্রাকার্স পোঁছায় না। তাই যেহেতু শুরু থেকেই বোম্বে সুইটস বাজারে ছিল এবং সহজলভ্যতা ও প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের কারনে পটেটো ক্রাকার্স ই বেশি গ্রহনযোগ্যতা পায়।
কারন হিসেবে উঠে এসেছে-
- শুরুতে বাজার কম্পিটিশন না থাকা– বর্তমানে দেশি বিদেশি কোম্পানি মিলিয়ে ২০টিরও বেশি স্ন্যাক্স ব্র্যান্ড চিপ্স মার্কেটে আছে। কিন্তু বাংলাদেশে চিপ্সের মার্কেট শুরুই বোম্বে সুইটসের হাত ধরে। ১৯৮৫ সালের দিকে কোন কম্পিটিটর কোম্পানি না থাকায় একচেটিয়া গ্রাহক মনে আস্থার জায়গা করে নিতে পেরেছে ব্র্যান্ডটি। ফলে ফার্স্ট মুভার্স সুবিধা পেয়ে যায় কোম্পানিটি।
- শক্তিশালী ডিস্ত্রিবিউশন নেটওয়ার্ক– বোম্বে সুইটসের শুধুমাত্র ঢাকাতেই পাঁচটি ডিস্ট্রিবিউটর আছে যাদের কাজ হল ‘Door to Door’ ডিস্ট্রিবিউট করা। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বা অঞ্চলের খুচরা দোকানে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সাধারনত এরা একক ভাবে নির্দিষ্ট দিনে উৎপাদিত পণ্য পৌঁছিয়ে দেয়। সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে দোকানে পৌঁছে যাওয়ায় অন্যান্যদের তুলনায় এই ব্র্যান্ডটি অনেক এগিয়ে। বাড়ির পাশে চা দোকানে হোক কিংবা ট্যুরে যাও্যার বেলায় হোক, আশেপাশে দোকানে তাকালেইর চোখে পড়ে বোম্বে সুইটসের চিপ্স/ক্রাকার্সকে। সচেতন বা অবচেতন মনে আমরা শুরুতেই বেছে নেই এই পন্যটিকে। কারন ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্টরা প্রোডাক্টের এভেইলেবিলিটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টেও বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন যাতে দোকানে আসলে শুরতেই চোখে পড়ে পণ্যগুলো।
- গ্রাহক চাহিদা ঃ রিটেইলার সার্ভে ২০১৭ এর রিপোর্ট অনুযায়ী পটেটো চিপ্স বা ক্রাকার্সের ৩৩ % গ্রাহকই ১১ থেকে ১৫ বছরের ভেতর হয়ে থাকে। ১৬ থেকে ২০ বছরের কিশোর গ্রাহকদের হার ২৪ % এবং ২১ থেকে ২৫ বছরের তরুনদের মধ্যে এই হার ১৫%। তাহলে দেখতেই পাচ্ছি, একটা বড় জনগোষ্ঠী ই অল্পবয়স্ক হওয়ায় এবং কম দামের কারনে বোম্বে সুইটসের চিপ্স ও ক্র্যাকার্স এখনো সবার চাহিদা শীর্ষে।
- স্বল্পমূল্য – এই সকল স্ন্যাক্স পন্য দাম নির্ভর হয়। তাই পণ্যর দাম বেড়ে গেলে, পন্যের চাহিদা কমে যাওার আশংঙ্কা থাকে। বর্তমানে বাজারে বেশির ভাগ চিপ্সই ১৫ থেকে ২০ বা ২৫ টাকা। ২০১৭ সালে এক রিপোর্টে দেখা যায় ১০ টাকার প্যাকেটজাত চিপ্স/ ক্রাকার্স ই বহুল বিক্রিত- মোট বিক্রয়ের ৫৮%। সে তুলনায় বোম্বে সুইটসের পটেটো চিপ্স ও ক্রাকার্সসের দাম শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দু’ থেকে তিনবার বৃদ্ধি পেয়েও ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১০ টাকাই ছিল। বর্তমানে দাম ১৫ টাকায় গড়ালেও দুষ্টু-মিষ্টি নস্টালজিয়া এবং স্বাদের কারনে বাজারের সবচেয়ে এগিয়ে ব্র্যান্ডটি। মিস্টার টুইস্ট ১৫ টাকা হলেও দাম অনুপাতে মান এবং পরিমান নিয়ে গ্রাহকরা সন্তুষ্ট।
- বিজ্ঞাপন ও বিপনন- বোম্বে সুইটসের শুরুর দিকে কয়েকটি বিজ্ঞাপন থাকলেও এখন তেমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না। কারন তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতা আকর্ষণ না করে মাঠ পর্যায়ে সহজ পন্য প্রাপ্তি নিশ্চিতে কাজ করছে । এতে করে ক্রেতা সন্তুষ্টির পাশাপাশি , পণ্য বিপনন ও বিক্রয়ে অন্য সব ব্র্যান্ড থেকে এগিয়ে আছে ।
বোম্বে সুইটস এবং পটেটো ক্রাকার্সের ভবিষ্যৎ-

বর্তমানে প্রেক্ষাপটে পন্যের চাহিদার সাথে গুণগত মানের সামাঞ্জস্য বজায় রাখতে হুমশিম খাচ্ছে ব্র্যান্ডগুলো। শুরুতে ১৮ -২২ গ্রাম পন্যের মূল্য ৫ থেকে ৮ থাকলে, পরবর্তীতে ২২ গ্রাম পন্যের দাম ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাও সে বেশ পুরনো কথা। বর্তমান সময়ে বেশকিছু বছর ধরে ১৭ গ্রাম ক্রাকার্স ১০ টাকা ছিলো যা সম্প্রতি বেড়েছে। ২০২২ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ গ্রাম পটেটো ক্রাকার্স ১৫ গ্রামে নামিয়ে ১০ টাকা দাম এবং ২৫ গ্রামের পটেটো ক্রাকার্সের দাম ১৫ টাকা ধরা হয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাটি সন্তোষজনক নয়। তবে এখন পর্যন্ত বাজারে এই ব্র্যান্ডটির প্রচার প্রসার ভালো বিধায় নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না অদূর ভবিষ্যতে ব্র্যান্ডটির মার্কেট শেয়ারে কেমন প্রভাব ফেলবে।