নিয়মিত কফি পান করেন কিন্তু স্টারবাকসের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোর তালিকা খুজলে অ্যাপল, কোকাকোলা বা গুগল এসবের সাথে সারির প্রথম দিকেই পাওয়া যাবে স্টারবাকসের নাম। শুধুমাত্র ‘tall’, ‘Grande’ অথবা ‘Venti’ এর মত ল্যাঙ্গুয়েজই নিজেদেরকে কফিশপ হিসেবে আবদ্ধ রাখেনি তারা। বরং কাস্টমারদের জন্য একটি ভিন্ন এক্সপেরিয়েন্স তৈরি করে কফির জগতে নিজেদের আধিপত্য জয় করে নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। সেই সাথে প্রচার মাধ্যমে তাদের নিয়ে বরবারই আলোচনা চলছে। তাছাড়া সাড়া জাগানো ড্রিংক ‘পাম্পকিন স্পাইস লাটে’ এর জনপ্রিয়তার কথাতো নতুন করে বলে দিতে হবে না। তবে এই কফি চেইনের শুরুটা খুব পরীক্ষামূলক হলেও বর্তমানে এটি কিন্তু কোনও র্যানডম কফি শপ নয়; যারা শুধু দামি কফি বিক্রি করে দুনিয়া মাতাচ্ছে। স্টারবাকসের সাফল্য ও বৃদ্ধির পেছনে রয়েছেন একজন দক্ষ মাস্টারমাইন্ড। যদিও আমরা সবাই কম বেশি এই স্টারবাকসের শুরুর গল্প জানি, তবুও ছোট্ট করে একটু মনে করিয়ে দেয়া যাক।
জেরি বোল্ডউইন, জেভ সিগাল, গর্ডন বোকার- এই তিন বন্ধু ১৯৭১ সালে সিয়াটলের ছোট্ট এক জায়গা জুড়ে দাঁড় করান তাদের কফির ব্যবসা। উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রে কফি কালচারকে পাকাপোক্ত করে গড়ে তোলা। কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শুধু ভালোমানের কফি বিন সেল করা। তবে তা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায় একজন মানুষের বদৌলতে, তার নাম হাওয়ার্ড শুলজ। তিনি ১৯৮২ সালে যুক্ত হোন স্টারবাকসের সাথে। এর ঠিক পরের বছরই কফি কিনতে ইতালি গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, শুধুমাত্র কফি বিন সেল করে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়। তাই কফি বিন বিক্রির পাশাপাশি রেডিমেড কফি বিক্রির দিকে নজর দিতে চান তিনি। এরপর নানান চড়াই-উৎরাই পার করলেও শেষ পর্যন্ত তার দূরদর্শিতা এবং সঠিক ব্যবসায়িক কৌশলই স্টারবাকসে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের শীর্ষে।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, ছোট একটি কফি বিন শপ কিভাবে শুধুমাত্র কফি সেল করেই এতো বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে? সেই ব্যবসার পেছনের কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েই আমাদের আজকের এনালাইসিসঃ
শুধু একটি কফি শপ নয়, একটি অভিজ্ঞতা
হাওয়ার্ড শুলজ ইতালির মিলান শহরে এক বিজনেস ট্রিপে গিয়ে খেয়াল করেন কফিশপগুলোতে শুধু মানুষ কফি পান করতেই আসছে না বরং কেউ আসছে কাজের উদ্দেশ্যে, কেউ মিটিং করতে, কেউ বা আড্ডা দিতে। এই ধারণাটিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ফিরে গিয়ে কাজে লাগান। যার ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র কফিবিন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান থেকে স্টারবাকস হয়ে উঠে কফিশপে। যেখানে হাওয়ার্ড শুলজ শুধুমাত্র কফিই বেচতে চাননি, চেয়েছেন এক একটি কফির কাপ যেন হয়ে উঠে এক একটি অভিজ্ঞতা। বসার আরামদায়ক ব্যবস্থার পাশপাশি এর চমৎকার পরিবেশ, দেখতে নান্দনিক অভ্যন্তরীণ নকশা এবং কাছাকাছি দূরত্বের মাঝেই অবস্থিত স্টোর; এসবকিছু মিলিয়ে ছোট্ট কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ স্টারবাকসকে এনে দিয়েছে চূড়ান্ত সাফল্য।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কাস্টোমারদের সহায়তা করা
স্টারবাকসে ঢুকতেই দোকানকর্মীদের মিষ্টি অভ্যর্থনা কিংবা আপনার পছন্দের পানীয় সম্পর্কে জেনে নেওয়ার বিষয়গুলো আপনার দৃষ্টি এড়ায় না নিশ্চয়? পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বজায় রাখতে ঠিক এই কাজগুলোই স্টারবাকস করে তাদের কাস্টমারদের সাথে। কাস্টমাররা যেন স্টোরে এসে ঘরোয়া অনুভূতি পায়। অর্ডারের শুরুতেই তারা কাস্টমারদের তাদের পছন্দের ড্রিংকসটি নির্বাচন করতে সাহায্য করে থাকে। শুধু তাই নয়, কাস্টমারদের রেগুলার অর্ডারটি মনে রাখে প্রতিটি স্টোরের কর্মচারীরা। যার ফলে কাস্টমাররাও রেগুলার স্টারবাকসে যেতে উৎসাহিত হোন।
নাম ডেকে কাস্টোমার সনাক্ত করা
বর্তমানে কমবেশি সকল কফিশপ গুলোতে কফি তৈরি হওয়ার পর কাস্টমারের নাম ধরে ডেকে কফি সার্ভ করার প্রচলন দেখা যায়। কফি কাপেও লেখা থাকে কাস্টমারের নাম। শুরু থেকে এই পদ্ধতিই ব্যবহার করে আসছে স্টারবাকস। তাছাড়া কাস্টমারের নামই নয়, পেশা বা তাদের আগ্রহের নানা জিনিস নিয়ে জিজ্ঞাসা করে থাকে কর্মীরা। এতে করে কাস্টমারদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন আরও গভীর হয় বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন সিইও।
ক্রেতাদের প্রাধান্য তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ
২০০৮ সালে ‘মাই স্টারবাকস আইডিয়া’’ নামে একটি ক্যাম্পেইন চালু করা হয়। সেখানে কাস্টমারদের কাছ থেকে ইউনিক কিছু সাজেশন চেয়ে আহবান জানানো হয়। এভাবে ‘ফ্রি বার্থডে ট্রিট থেকে’ শুরু করে ‘গ্রিন স্প্ল্যাশ স্টিক্স’ এমনই ৩০০’শর ও বেশি আইডিয়া তারা তাদের স্টোরগুলোতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া কাস্টমাররা তাদের পছন্দের ফ্লেভার দিয়ে ইচ্ছেমত ড্রিংকস কাস্টমাইজড করে নিতে পারেন। স্টারবাকস ড্রিংকস নয় বরং কাস্টমারের দেওয়া নাম অনুসারে রাখা হয় ড্রিংকস গুলোর নাম। এছাড়া জিওলোকেশন ভেদে এমন কিছু ‘লিমিটেড এডিশন’ বা ‘স্পেশাল ফ্লেভার’ এর ড্রিংকস তারা বাজারজাত করে যা শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট লোকেশনই পাওয়া যায়। যেমন স্টারবাকস জাপানে এমন ৭টি ভিন্ন ফ্লেভারের কফি ড্রিংকস রয়েছে যা জাপানের বাইরে পৃথিবীর অন্য কোনো স্টারবাকস স্টোরে নেই।
হাঁটার দূরত্বেই দোকানের অবস্থান
‘স্ট্যাটিস্টা ২০২২’ এর হিসেব বলছে বিশ্বজুড়ে স্টারবাকসের ৩৩,৮৩৩টি কফিশপ রয়েছে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রতেই তাদের স্টোরের সংখ্যা ১৫,০০০ হাজারেরও বেশি। সেগুলোতে বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ৮ মিলিয়নেরও বেশি কফি বিক্রি হয়। স্টারবাকস তাদের কাস্টমার সার্ভিসে ‘Meet your customers where they want to be met’ পলিসিতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ আপনি যেখানেই যে প্রয়োজনেই থাকুন না কেন আশেপাশে স্টারবাকসের শপ আপনার চোখে পড়তে বাধ্য। কোনটি আড্ডা দেওয়ার জন্য আবার কোনটি বসে অফিস মিটিং বা কাজ করার জন্য উপযুক্ত। এমন এভাবেই তারা তাদের স্টোর লোকেশন ঠিক করে যাতে করে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে সকলেই স্টারবাকসে একটু ঢুঁ মেরে যায়। আর এই জিওগ্রাফিক লোকেশন ঠিক করতে রয়েছে তাদের দক্ষ ম্যানেজমেন্ট টিম।
মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে উদ্ভাবনী ডিজিটাল সমাধান
দ্রুততালে এগিয়ে চলা দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে স্টারবাকস ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া ছাড়াও অনলাইন বা ডিজিটাল মিডিয়ার উপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার সকল সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের প্রেজেন্স চোখে পড়ার মত। এছাড়া ২০০৯ সালে তারা তাদের অ্যাপ লঞ্চ করে যেটি ২০১১ সালে অনলাইন পেমেন্ট গ্রহণ করা শুরু করে। শুরুর ৯ সপ্তাহের মধ্যে ৩ মিলিয়ন ডলার ট্রানজেকশন হয়। এরপর স্টারবাকস কার্ড প্রোগ্রামের আন্ডারে ২০১১ অর্থ বছরে ২.৪ বিলিয়ন ডলার জমা পড়ে স্টারবাকসের ঝুলিতে। ২০১৪ সাল নাগাদ তারা মোবাইল অ্যাপে প্রি-অর্ডার সুবিধা চালু হয় যেখানে কাস্টমার অ্যাপ ব্যবহার করে আগাম পেমেন্ট করার বিপরীতে বিভিন্ন রিওয়ার্ড, গোল্ডেন স্টার, বার্থডে রিওয়ার্ড, ফ্রি স্টোর রিফিল, পছন্দের স্পোর্টিফাই মিউজিক চুজ করা সহ লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াই তার কফি ড্রিংকসটি পেয়ে যাওয়ার মত সুবিধাগুলো থাকে। গোল্ডেন স্টার রিওয়ার্ড ব্যবহার করে যেকোনো সময় কাস্টমার ফ্রি ড্রিংক অথবা খাবার রিডিম করতে পারেন। এটিকে ‘Starbucks Loyality Reward Programme’ বলা হয়। স্টারবাকস কার্ড, অ্যাপেল পে, গুগল পে সহ ভিসা বা মাষ্টারকার্ড ব্যবহার করে কাস্টমাররা তাদের অগ্রিম টাকা জমা রাখতে পারেন। পরবর্তীতে এই অগ্রিম জমার বিপরীতে অ্যাপের মাধ্যমে কফি কিনলে তারা তাদের পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন লেভেল স্টার পান। যা দিয়ে অ্যাপ ব্যবহারকারিরা অন্যদের তুলনায় বাড়তি কিছু সুবিধা অর্থাৎ রিওয়ার্ডস পেয়ে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে কাস্টমারকে নানান ধরনের সেবা দিলেও, স্টারবাকস বিনা সুদে বিপুল অঙ্কের ক্যাপিটাল একসাথে পেয়ে যায় যা পরবর্তীতে তাদের স্টোর এক্সপানশনের জন্য মূল ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রতি বছর সচল স্টারবাকস রিওয়ার্ডস মেম্বারদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। শুরুতে যা ছিল মাত্র ২ মিলিয়ন তা ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে ২৫ মিলিয়নে এসে ঠেকেছে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের স্টোরগুলোতেই। তাদের মোট বিক্রয়ের ৫৩ শতাংশই আসে এই রিওয়ার্ড প্রোগ্রাম থেকে। কোভিড ও তার পরবর্তী সময়েও এই রিওয়ার্ডস প্রোগ্রাম রিটেইলারদের ব্যবসা পুনরুদ্ধার করতে বেশ সাহায্য করেছে। বর্তমান সিইও কেভিন জনসন এটিকে “The great human reconnection” এর উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
অনলাইন পেমেন্ট মেথড
সারাবিশ্বে এখন ক্যাশলেস পেমেন্টকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেসের একটি জার্নালে প্রকাশিত হাইপোথিসিস অনুযায়ী, আমরা যখন নগদ টাকা ব্যবহার করি তখন যতটুকু না ব্যয় করি তার চেয়ে বেশি ব্যয় করি যখন ক্যাশলেস কেনাকাটার সময়। তাই স্টারবাকস ও তাদের কাস্টমারদের অ্যাপের মাধ্যমে পেমেন্টে উৎসাহিত করে। সেই সাথে অ্যাপে পেমেন্ট করার জন্য তারা কাস্টমারদের আলাদা রেটিংও দিয়ে থাকে যা পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে কাজ করে কাস্টমারের জন্য। ফলে একজন কাস্টমার আবারও সেই এক্সপেরিয়েন্স পেতে স্টারবাকস ভিজিট কর। নিজেদের এবং কাস্টমারের সময় বাঁচানোর পাশাপাশি এখানে স্টারবাকসের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য পূরণ হয়।
পণ্যের মানের দিকে সর্বদা মনোযোগ
ইতিমধ্যে জেনেছি স্টারবাকসের শুরুটাই হয়েছিল কফিবিন বিক্রয় করার মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে যখন প্রথম তারা বাজারে আসে, অল্পদিনেই সেরা কফিবিন বিক্রেতার খেতাব লাভ করে। বর্তমানে ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাফে মার্কেটের ৫৭ শতাংশ জায়গা দখল করে রেখেছে তারা। কারণ একটাই, ভালো মানের কফিবিন এবং তাদের সার্ভিস। হাওয়ার্ড শুলজ, ২০০৮ সালে পুনরায় স্টারবাকসের দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন কিছু পরিবর্তন আনেন। স্টোরেরে স্বয়ংক্রিয় কফি মেশিনগুলোকে সরিয়ে ফেলেন তিনি। পাশাপাশি স্টোরের বারিস্তাদের কফি বানানোর উপর স্পেশাল প্রশিক্ষণের ও ব্যবস্থা করেন। এভাবেই নিজেদের গুণে ও মানে উন্নতির শিখরে পৌঁছে প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া দৈনিক হাজার খানেকেরও বেশি কাপ কফি ভেরিফাই করা হয় শুধুমাত্র মান উন্নয়নের লক্ষ্যে।
কফি টেকআউট মডেল চালু
স্টারবাকস প্রতিনিয়তই তাদের কাস্টমার সার্ভিসে সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই তাদের রিসার্চ টিম প্রায় ২০০ জন লোকের সাথে কথা বলে জানতে চায় তারা কি কি সুবিধা আশা করে স্টারবাকসের কাছ থেকে। তারা জানান কফি টেক আউটের বিষয়টির কথা। সেই সময় ক্যাফে বা শপে বসে কফি খাওয়ার প্রচলন থাকলেও ছিল না কোনও টেকআউট মডেল। স্টারবাকসের এই উদ্যোগ কফি খাওয়ার রেওয়াজ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
সফল গ্রাহক সেবার পাশাপাশি অন্যন্য ব্যবসা ব্যবস্থা স্টারবাকসকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। তাদের স্টোরগুলোর যথাযথ অবস্থানের কারণে এলাকার সিংহভাগ মানুষেরই সকালের কফির জন্য প্রথম পছন্দ থাকে স্টারবাকস। সেই সাথে অফিশিয়াল মিটিং কিংবা কোনও বন্ধুর সাথে মিট-আপ, সকল ক্ষেত্রেই স্টারবাকস থাকে তালিকার প্রথম দিকে।
স্টারবাকসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- কাস্টমার সার্ভিস। বলা হয়ে থাকে, কাস্টমার সার্ভিস তাদের সাকসেসের মূল উপকরণগুলোর একটি।