জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে আমাদের চাহিদা। বদলে যাচ্ছে রুচিবোধও। কেনা কাটায় আসছে পরিবর্তন। একসময় বিদেশী পোশাক ও অন্যান্য পণ্য কেনার উপর আগ্রহ থাকলেও দিনদিন বাড়ছে দেশীয় পণ্যের চাহিদা। তাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর সংখ্যা। টার্গেট কাস্টোমার, সঠিক ব্র্যান্ড পজিশনিং ও মার্কেট যাচাইয়ের মাধ্যমে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো এখন দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে ছাড়িয়ে বিদেশী বাজারেও জায়গা করে নিচ্ছে। আজ আমরা এরকমই কিছু দেশীয় ব্র্যান্ড এবং তাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে জানবো-
আড়ং
দেশীয় ব্র্যান্ডের কথা হবে আর আড়ং থাকবে না তা কি করে হয়। ১৯৭৮ সালে ড. ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরে ব্র্যাকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আড়ং-এর যাত্রা শুরু যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম লিডিং এথনিক ও ট্র্যাডিশনাল রিটেইল চেইন হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট এবং রাজশাহীতে ২৫টি আউটলেটে ১০০টিরও বেশি ধরনের পণ্য নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আড়ং, বাংলাদেশের বাকিসব ফ্যাশন ব্র্যান্ডের মতো হলেও এটি কাজ করে লাইফস্টাইল নিয়ে। আড়ং মাঠ পর্যায়ে গ্রামীণ কুঠির শিল্পীদের তৈরি পণ্য বাজারজাত করে থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই দুনিয়াতে বিদেশী ও দেশি পণ্যের ভেতর আড়ং এখনো ধরে রেখেছে বাংলাদেশের ফ্যাশন বাজার। আর এর পেছনে রয়েছে আড়ং-এর ব্র্যান্ডিং ও পরিকল্পিত মার্কেটিং ।
কখনও ভেবেছেন কুটিরশিল্পীদের হাতে তৈরি পোশাকে কেমন দেখাবে বিলবোর্ডের সুপার মডেলদের? ৪০ বছরের ও বেশি সময় ধরে আড়ং প্রচলিত ধারার বিজ্ঞাপনের বাইরে গিয়ে এইভাবেই তাদেরকে প্রমোট করে আসছে। পাশাপাশি আড়ং তাদের মার্কেট পজিশনিং-এ ‘High Price Policy’ গ্রহণ করে আসছে। আর তাই সবসময়ের আলোচনা-সমালোচনাতে জড়িয়ে থাকলেও অন্যান্য প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি দামে ইউনিক ও বেস্ট কোয়ালিটি পণ্য ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়াতে ক্রেতারা সহজেই আকর্ষিত হয়। এছাড়া আড়ং-এর মিডিয়া প্রেজেন্সও ভিন্ন প্রকৃতির। বিলবোর্ডে, ম্যাগাজিন, পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা আড়ং এর বিজ্ঞাপন দেখে থাকি। ব্র্যান্ডটি মূলত বিভিন্ন থিম বেইসড যেমন পৌষপার্বণ, ঈদ, পহেলা বৈশাখ বা যেকোনো উৎসবকে মাথায় রেখে তাদের পণ্যের কমার্শিয়াল ফটোশুট করে থাকে যেখানে নান্দনিকতা ও আভিজাত্যকে পোশাকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। এইসকল শুট বেশ নামীদামী মডেলদের দিয়ে করানো হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ট্রাডিশনালিটির সাথে কনটেম্পোরারি সময়ের মিশেলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। লক্ষণীয়, আড়ং-এর মার্কেটিং পলিসিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তাদের ‘কমলা ও কালো’ রঙের নজরকারা শপিং ব্যাগটি। যারা আড়ং এর ক্রেতা নন তারাও দূর থেকে দেখেই বলে দিতে পারেন যে এই ব্যাগটি আড়ং-এর, যা সবচেয়ে বেশি ব্র্যান্ডভ্যালু এড করে।
ইয়েলো
বেক্সিমকো কোম্পানির পোশাকের রিটেইল ব্র্যান্ড হিসেবে ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের ফ্যাশন জগতে যুক্ত হয়েছে, ইয়েলো। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সহ তাদের মোট ১৫টি আউটলেট রয়েছে। মূলত ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিটির ডিজাইন এবং ফেব্রিকের জন্য সমাদৃত এই ব্র্যান্ডটি। এছাড়া হোম ডেকোর থেকে শুরু করে পেইন্টিং, সিরামিকের আইটেম রয়েছে তাদের প্রোডাক্ট লাইনে। ইয়োলোর মূল উদ্দেশ্য মডার্ন ফ্যাশনকে কমফোর্টের সাথে মিশিয়ে বাজারে নতুন চাহিদা তৈরি করা। ব্র্যান্ডটি মূলত সেমি ক্যাজুয়াল, অফিস গোয়িং আউটফিটকে প্রমোট করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু বর্তমানে দু’টি মার্কেটে কম্পিটিশন করছে সেহেতু পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিজ্ঞাপনে তারা গ্রাহক পর্যায়ের চাহিদা ও সন্তুষ্টি কে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে ইয়েলো সেমি-ফরমাল, ক্যাজুয়াল পোশাকে প্রাধান্য, পাকিস্তানের বাজারে, তাদের বাজার চাহিদা কে মাথায় রেখে কাজ করে থাকে। মার্কেটিংও করা হয় পণ্যের চাহিদা অনুসারে। বাংলাদেশে ইয়েলো মডার্ন ফ্যাশনপ্রেমীদের কাজে সমাদৃত।
দেশাল
দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের তালিকায় শুরুতেই পরিচিত এক নাম দেশাল। উঠতি বয়সী কিশোরী থেকে পৌঢ় বৃদ্ধা, ব্যাপার যখন ১২ হাত শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে তোলার, দেশালের চাহিদা চারিদিকে। ২০০৫ সালে তিন বন্ধুর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় দেশালের। শুরু থেকেই দেশাল তাদের ব্র্যান্ডকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে। লক্ষ্যত, দেশালের রয়েছে পোশাক তৈরির নির্দিষ্ট প্যাটার্ন, রঙ এবং নকশা। মূলত দেশীয় শিল্পকে পোশাকের মাধ্যমে শুরু নিজ ঘরানায়ই নয় বরং বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার প্রসারে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু শাড়িই নয়, দেশালের সালোয়ার কামিজ, কুর্তি, ধূতি, পাঞ্জাবী, ছোট্ট শিশুদের পোশাক এবং গৃহস্থালি সাজানোর তৈজসপত্রাদির চাহিদাও কম নয় রুচিশীল ক্রেতাদের কাছে।
দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে দেশালের ভিন্নতার পেছনে আছে তাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি-
দেশাল কাজ করে প্রান্তিক লেভেলের ছোট কারিগরদের সাহায্যে। এতে করে দেশালের যে মূল উদ্দেশ্য – ট্র্যাডিশনাল ধাঁচের পোশাককে হালফ্যাশনের সাথে জিইয়ে রাখা তা পূরণ করতে পারছে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছে দেশীয় পোশাকের সংস্কৃতির সাথে।
দেশালের বিজ্ঞাপনগুলোতে ঝকঝকে লাইট, ক্যামেরা, একশন অথবা নামীদামী মডেলকে মুখ্য ভাবে তুলে ধরা হয় না। তাদের ব্র্যান্ডের ধাঁচের সাথে মিল রেখে গুরুত্ব দেওয়া হয় গ্রামীণ পরিবেশে দেশীয় পোশাকের সাবলীলতাকে। দেশাল মূলত টার্গেট করে ক্রেতাদের যারা নিজেকে আর তাদের আশপাশকে ভিন্নভাবে দেখতে পছন্দ করেন। তাই প্রায়ই জাতীয় দৈনিকের লাইফস্টাইলের পাতায় আমরা দেশালের বিজ্ঞাপন বেশি দেখতে পাই। বর্তমানে সারাদেশে দেশালের ঢাকা , চট্টগ্রাম ও সিলেটে ৬ টি আউটলেট রয়েছে। সম্প্রতি বনানীতে তারা তাদের ফ্ল্যাগশীপ স্টোর উদ্বোধন করেছে।
রিচম্যান
বাংলাদেশে ছেলেদের জন্য আলাদা করে ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠান কম হলেও ছেলেদের ফ্যাশন জগতে অতি পরিচিত এক নাম ‘রিচম্যান’। ইতোমধ্যেই এক্সক্লুসিভ ডিজাইন এবং ফ্যাশনেবল ম্যান্সওয়্যারের জন্য বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পাঞ্জাবী থেকে শুরু করে স্যুট, ফরমাল শার্ট, ক্যাজুয়াল শার্ট, প্যান্ট, ট্রাউজার, বেল্ট, ওয়ালেট, পারফিউম সকল কিছু একই ছাদের নিচে হওয়ায় ক্রেতারা একসাথেই সবকিছু কিনতে পারেন। ‘লুবনান ট্রেড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড’ এর আন্ডারে তিনটি সাব ব্র্যান্ড – লুবনান, রিচম্যান এবং ইনফিনিটি মেগামল ২০০৩ সালে তাদের যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ঢাকা ও অন্যান্য জেলা শহর গুলোতে ৪৭টি আউটলেট রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। রিচম্যান প্রতিনিয়ত স্মার্ট, কমফোর্টেবল এবং ফ্যাশনেবল ম্যান্সওয়্যার নিয়েই কাজ করছে। রিজনেবল থকে হাইএন্ড সব ধরনের রেঞ্জের পোশাক পাওয়া যায় বলে ফ্যাশন ব্র্যান্ডের শীর্ষ তালিকায় উঠে আসে এই প্রতিষ্ঠানটি। মডেল ও অভিনেতা নোবেল এই প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
ইজি ফ্যাশন
ইজি ফ্যাশন ব্র্যান্ডটির মূল টার্গেট কাস্টমার হল ইয়াং এবং তরুণ কলেজ বা ইউনিভার্সটিগামী ছেলেরা। ২০০৯ সালে এই দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি তাদের যারা শুরু করে। বেসিক কিংবা ডিজাইনের টি-শার্ট, পলো বা পাঞ্জাবী সবকিছুই বাজারে এনেছে তারা। শুধু কমফোর্ট নয় দামে সাশ্রয়ী বিধায় ছেলেদের কাছে বেশ পরিচিত এই প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া বোল্ড ও আকর্ষণীয় দেখায় এমন পোশাক নিয়ে তারা কাজ করছে। বর্তমানে ১১টি ব্রাঞ্চ রয়েছে তাদের। গতানুগতিক বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ইজি ফ্যাশন ডিজিটাল মিডিয়াতেও তাদের উপস্থিতি জানায় দেয়। ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে বেশ কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠানটি। চিত্রনায়ক ও অভিনেতা আরেফিন শুভ এর প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। এছাড়া বিভিন্ন স্পোর্টস পারসোনালিটি, যেমন- মোহাম্মদ আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফিসের মত ব্যক্তিত্বদের স্পন্সর করে থাকে।
সাদাকালো
২০০২ সালে ঢাকার রাইফেলস স্কয়ারের ছোট্ট দোকানটি বর্তমানে দেশের মাত্রা ছাড়িয়েও বিদেশের মাটিতে মাল্টিচেইন আউটলেট অপারেট করছে। শুধুমাত্র ফ্যাশনেবল ট্র্যাডিশনাল পোশাক নয় ভিন্নমাত্রার ব্র্যান্ড ভ্যালু গড়ে তোলাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তাই শুধুমাত্র দু’টি রং- সাদা এবং কালো কে ফোকাসে রেখে তৈরি করা হয় এই ব্র্যান্ডের সকল ধরনের পোশাক গুলো। বাংলাদেশে এই ধরণের আর কোন ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান নেই। খুব অল্প সময়ে আড়ং, দেশাল, বিবিয়ানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে প্রতিযোগিতার কাতারে উঠে আসে সাদাকালো। প্রতিষ্ঠানটির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে অভিনেতা দম্পতি আলী যাকের ও সারা যাকেরের মাধ্যমে করানো প্রোমোশনকে ধরা হয়। এছাড়ারাও বিজ্ঞাপন, নানা উৎসব পার্বণে ছাড়, জনপ্রিয় লাইফস্টাইল পত্রিকায় ফিচার ও ডিজিটাল মার্কেটিঙের মাধ্যমে ব্র্যান্ডটি নিজেদের মার্কেটিং ও প্রোমোশন করে আসছে।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড বা হাউস গুলো বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক লোকেশন অর্থাৎ আউটলেট ছাড়াও অনলাইনে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কাছে এবং দূরে সকলের কাছে তাদের পণ্য সরবরাহ করছে। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপেয়ারেন্স এবং চলমান ধারার বিজ্ঞাপন তৈরি করার মাধ্যমে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। সেদিন আর বেশি দূরে নেই যখন দেশের প্রতিটি ঘরে বিয়ে থেকে শুরু করে যেকোনো উৎসবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষ দেশীয় পণ্যকে বেছে নেবে।