পরপর দুই মাসে দুটি বিশ্বকাপ উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে পুরো ক্রীড়া দুনিয়া। অক্টোবর-নভেম্বরে আইসিসি টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপ আর নভেম্বর-ডিসেম্বরে ফিফা বিশ্বকাপ। আর বিশ্বকাপ মানেই যেন ক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য স্বর্গীয় অনুভূতি। তবে বিশ্বকাপের পাশাপাশি প্রত্যেক খেলাতেই একটি ব্যাপার খুব দারুণভাবে লক্ষ্য করা যায়। সেটি হলো অ্যাম্বাসেডর হিসেবে খেলোয়াড়দের ব্র্যান্ডগুলোর সাথে চুক্তি। স্পোর্টস-ওয়্যার থেকে শুরু করে সময়ের সাথে মানানসই যে কোন ব্র্যান্ডই চায় তারকা খেলোয়াড়টিকে বা তার দলকে তাদের অ্যাম্বাসেডর বানাতে। কথা যেহেতু ফুটবল আর ক্রিকেট নিয়ে হচ্ছে, এই দুই দুনিয়ার অ্যাম্বাসেডরশীপ নিয়েই আজকের আয়োজনটি।
বিখ্যাত স্পোর্টস-ওয়্যার ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস এবং নাইকির কথাই ধরা যাক। প্রতিবছরই ব্র্যান্ডগুলোর মুখপাত্র বা অ্যাম্বাসেডরদের তালিকায় থাকে তারকা খেলোয়াড়রা। ব্যক্তিগতভাবে কিংবা গোটা দল, উভয় ক্ষেত্রেই খেলোয়াড়দের অবস্থান লক্ষণীয়। তবে ক্রিকেট আর ফুটবল জগতে তাদের অ্যাম্বাসেডরশীপের অনুপাতটা কেমন যেন বেমানান। ফুটবলে নাইকি ৩২টি জাতীয় দলের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে ২০০টিরও বেশি ক্লাব দলকে তারা জার্সি স্পন্সর করে থাকে। আর একক খেলোয়াড়ের সংখ্যা তো বলতে গেলে হাজার ছুঁই ছুঁই! এর মাঝে রয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং এমবাপেদের মতো তারকারা। কিন্তু ক্রিকেটে নাইকি অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশের ৮টি দল আর ইংল্যান্ডের ৫টি কাউন্টি দলের বাহিরে দলীয় কিংবা ব্যক্তিগত কোন খেলোয়াড়ের সাথে পৃষ্ঠপোষকতার দেখাই পাওয়া যায় না। অন্যদিকে অ্যাডিডাসের দৃশ্য ক্রিকেটের জন্য তুলনামূলক ভিন্ন বলা চলে। ফুটবলে ২৯টি জাতীয় দলের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি তারা হাজারের বেশি ক্লাব দলের পৃষ্ঠপোষক। আর ফুটবলারদের ব্যক্তিগত অ্যাম্বাসেডরশীপের তালিকায় রয়েছেন লিওনেল মেসিসহ হাজারেরও বেশি ফুটবলার। সেই সাথে ফিফা বিশ্বকাপ আর ইউরোপের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ আর উয়েফা ইউরোর মতো টুর্নামেন্টে অ্যাডিডাস অংশীদার হিসেবে যুক্ত আছে। ঠিক এইভাবেই, ফুটবল দুনিয়া যতোটা রঙিন, ক্রিকেটের দুনিয়া ততোটাই ফ্যাকাসে। জাতীয় দলের সাথে মাত্র ৩টি ইংল্যান্ড কাউন্টি দল আর সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে প্রায় ৩০ জন একক ক্রিকেটার রয়েছে অ্যাডিডাসের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে।
অবশ্যই উভয় ক্রিকেটার এবং ফুটবলার দেশীয় বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর হয়ে থাকেন। কিন্তু সেই সংখ্যাটিও কম। বাংলাদেশ কিংবা ভারতের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়। হাতে গোনা কয়েকজন ক্রিকেটার ছাড়া খুব কম ক্রিকেটারকেই দেখা যায় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে। তাহলে ক্রিকেট আর ফুটবলে এতো বিস্তর ফারাকের কারণ কী? এর জন্য আমাদের দেখতে হবে খেলা দুটির বাজার তারতম্য, টেলিভিশন ভিউয়ারশিপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খেলা’দুটি কতোটুকু প্রতিযোগিতাপূর্ণ।
বাজার তারতম্য
প্রথমে আসি বাজার তারতম্যের ব্যাপারে। খেলা দুটি’র বাজার হিসাব করতে গেলে বিবেচনায় রাখতে হবে খেলার সরঞ্জাম, খেলার মাঠকে কেন্দ্র করে নানান সেবা এবং খেলোয়াড়সহ খেলার সাথে সরাসরি জড়িত কর্তাদের বেতনভাতার বিষয়গুলো। ২০২১ সালের আইসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্বের মোট বাজার মূল্য ৩৩.০৩৬ কোটি মার্কিন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৮ সাল নাগাদ এই বাজারের মূল্য হবে ৩৭.৪৪ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বর্তমান থেকে প্রায় ১৩.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বাজারের আকার।
অপরদিকে ফুটবলের বাজার মূল্যের দিকে তাকালে আপনার চোখ কপালে উঠে যাবে। ফিফার ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে ফুটবলের বাজারমূল্য ৩০২ কোটি মার্কিন ডলার, যা ক্রিকেটের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি। ২০২৭ সাল নাগাদ এটির আকার হবে ৩৮৭ কোটি মার্কিন ডলার যা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
টেলিভিশন ভিউয়ারশিপ
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটপ্রেমীর সংখ্যা প্রায় আড়াইশো কোটির বেশি যেখানে ফুটবলপ্রেমীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো কোটির উপরে। এই ১০০ কোটির পার্থক্যের কারণে কিভাবে খেলা দুটির বাজার আকারে প্রায় ১০গুণ পার্থক্য দেখা যেতে পারে? এর উত্তর পাওয়া যাবে খেলা দুটির দর্শক ঘনত্বের দিকে তাকালে। ক্রিকেটের সিংহভাগ দর্শক অবস্থান করে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আরব আমিরাতে। এই দেশগুলোতে দর্শকের পরিমাণ যথাক্রমে ৫৩%, ২৬%, ১৫%, ৩৯% এবং ২৫%। আইসিসির বাকি পূর্ণ সদস্যভুক্ত দেশগুলো মিলে রয়েছে মোট ১০ শতাংশ দর্শক। আর বিশ্বের বাকি দেশগুলোতে ক্রিকেটপ্রেমীর সংখ্যা ৫ শতাংশেরও নীচে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই মাত্র ১ শতাংশ মানুষ নিয়মিত ক্রিকেট খেলা অনুসরণ করে। স্পষ্টত, পুরো বিশ্বে মাত্র অল্পকটি দেশে সিংহভাগ ক্রিকেটপ্রেমী অবস্থান করছে।
উলটো দৃশ্য দেখা যায় ফুটবলের বেলায়। ইউরোপ, এশিয়া প্যাসিফিক, মধ্য প্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা এবং উত্তর আমেরিকায় নিয়মিত ফুটবল খেলা দেখে এমন দর্শকের সংখ্যা যথাক্রমে ৪৭%, ৫০%, ৫৬%, ৬২% এবং ২৪%। দেখতেই পাচ্ছেন ফুটবলের ক্ষেত্রে দর্শকের সংখ্যা মোটামুটি বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে আছে। আর এইখানেই ক্রিকেটের তুলনায় এগিয়ে গেছে ফুটবল।
প্রতিযোগিতাপূর্ণ খেলার ধরণ
আমরা আগেই জেনেছি খেলা দুটি’র বাজারমূল্যের তারম্যের বিষয়টি। এই বিশাল তারতম্যের কারণ জানতে হলে আমাদের বুঝতে হবে খেলা দুটি একটি অপরটির তুলনায় কতোটি প্রতিযোগিতাপুর্ণ।
এখানে প্রতিযোগিতাপূর্ণ খেলা বলতে মূলত বুঝানো হচ্ছে কত সংখ্যক দেশ একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করেছে। কেবল বিশ্বকাপ এবং আনুষঙ্গিক সকল ম্যাচের দিকে তাকালে এর একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
তার আগে চলুন, ক্রিকেট আর ফুটবল এই দুই খেলার ধরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক আকারের ব্যাপারে জেনে নেয়া যাক। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসির সদস্য হিসেবে রয়েছে ১০৮টি দেশ যারা কোন না কোন মাধ্যমে নিজ দেশে ক্রিকেট আয়োজন করে থাকে। এই ১০৮টি সদস্যের মধ্যে মাত্র ১২টি দেশ রয়েছে যাদের পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। পূর্ণ সদস্য মানে হলো এই ১২টি দেশ নিজেদের সাথে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারবে। বাকি দেশগুলো এই পূর্ণ সদস্য তো দূরের কথা, নিজেদের মাঝেও ক্রিকেট খেলতে কতো নিয়ম পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। অপরদিকে ফিফার সদস্য সংখ্যা ২১১টি। এখানে পূর্ণ সদস্য বা আধা সদস্যের কোন ঝামেলা নেই। একবার সদস্য হওয়া মানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেকোনো দেশের সাথে ফুটবল খেলতে পারার সুযোগ পাওয়া।
এবার লক্ষ্য করুন, আমরা বাংলাদেশীরা যখন ক্রিকেটের কোন খবর নেই, তখন দেখা যায় হয় বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা শ্রীলংকার সাথে খেলছে, অপরদিকে ভারতের সাথে ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া খেলছে কিংবা পাকিস্তানের সাথে নিউ জিল্যান্ড খেলছে। নতুন খবরের মধ্যে আফগানিস্তান এবং আয়ারল্যান্ডের খেলাও দেখা যায়। কিন্তু এর বাহিরে কোন খবর আপনি পাবেনই না বলতে গেলে। খোদ ৪৮টি দেশের এশিয়া মহাদেশে এশিয়া কাপ খেলে মোটে ৪-৫টি দেশ! এমনকি বিশ্বকাপেও দেখতে পাবেন একই দশা। টি২০ বিশ্বকাপের ধরণটাই দেখুন। ৮টি দল আগে থেকেই সুপার ১২ তে জায়গা করে রেখেছে। বাকি ৮টি দলের মধ্যে ৪টি দল সুপার ১২তে যোগ দিবে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে। ভিন্নভাবে দেখলে ব্যাপারটি এমন যে, তোমাদের শক্তি উপরের ৮টি দলের তুলনায় কম। তাই নিজেরা একটু বাছাই হয়ে আসো! এর ফলে যেটি হচ্ছে, ক্রিকেটের বিকেন্দ্রীকরণ বা বিশ্বায়ন কোনটিই হচ্ছে না। হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যেই ক্রিকেটের মূল খেলা চলছে। বাকি সদস্য দলগুলো অনেকটাই দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
এই ব্যাপারটি ফুটবলে দেখা যায় না। ফিফার বিশ্বকাপ আয়োজনে কেবল আয়োজক দেশ ছাড়া বাকি সবাইকেই বাছাই পর্ব পেরিয়ে আসতে হয়। এখানে সবাই সমান সুযোগ পায় বিশ্বকাপে নিজেদের জায়গা করে নেয়ার। এর ফলস্বরূপ, চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইটালি কিন্তু পরপর দুই বিশ্বকাপে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিতে পারেনি। মহাদেশভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতেও দেখা যায় সকল সদস্য রাষ্ট্রের উপস্থিতি। আর বন্ধুত্বপূর্ণ খেলাগুলোতে আর্জেন্টিনার সাথে থাইল্যান্ড কিংবা ব্রাজিলের সাথে হংকং এর কোন ম্যাচ কিন্তু অবাক করার মতো কোন বিষয় নয়। অর্থাৎ এখানে সবারই অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে। সেই সাথে ৪ বছর পর পর বিশ্বকাপে মোট ৩২টি দল প্রতিযোগিতা করে বিশ্বকাপ শিরোপার জন্য।
তুলনা করে দেখুন, ক্রিকেটের বিশ্বকাপের মূল পর্বে যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে ১২টি দল, সেখানে ফুটবল বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে রয়েছে ৩২টি দল। অর্থাৎ ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবলের প্রতিযোগিতা বেশি এবং এর ফলে ফুটবলের বাজারের আকারও ক্রিকেটের তুলনায় বহুগুণে বেশি। আর যেখানে বাজারের আকারের এতো বিশাল পার্থক্য, সেখানে দর্শকের হিসাব নিকাশে পার্থক্য তো থাকবেই! আর গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলো চায় তাদের অ্যাম্বাসেডর হিসবে এমন তারকাকে নির্বাচন করতে যাদের মাধ্যমে তারা সহজেই বিশাল পরিমাণ বাজার নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে পারে। যেখানে ক্রিকেটের বাজারটাই এতো ছোট আর মাত্র অল্প কয়টি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলো বেশি আগ্রহ দেখাবে না এমনটিই তো খুব স্বাভাবিক।