ভদ্রলোকের খেলা নামে খ্যাত ক্রিকেট মানেই এখন যেন কেবল টাকার খেলা। ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক প্রতিযোগিতার আগমনের ফলে বদলে গিয়েছে পুরো ক্রিকেট বিশ্বের চিত্র। শতাব্দীর শুরুতে যেখানে দর্শকদের আকর্ষণ করার জন্য ‘ক্রিকেট’ রীতিমত লড়াই করছিল সেখানে এখন ক্রিকেট বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয়-সবচেয়ে মূল্যবান স্পোর্টিং ফ্র্যাঞ্চাইজি। শুধুমাত্র ব্যাটে-বলে চার-ছক্কাতেই নয় বরং কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাটি। বেশ নাটকীয়ভাবেই বদলে গেছে খেলাটির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
চলতি বছরের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপই এর এক জ্বলন্ত উদাহরণ। বিশ্বকাপ মানেই মাঠভর্তি দর্শক আর টেলিভিশনের সামনে সকলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কখন একটি উইকেট পড়বে আর মোড় ঘুরে যাবে পুরো ম্যাচের। আর এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্যই মরিয়া হয়ে উঠে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো। দর্শকদের মন আর ফ্রাঞ্চাইজির মার্কেটে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেয়ার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে থাকে এসকল প্রতিষ্ঠান; এবং এদের অধিকাংশই আইসিসির সাথে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে একাধিক বছরের জন্য।
শুরুতেই বলে নিই, বিশ্বে ক্রিকেটপ্রেমীদের সংখ্যা প্রায় ২৫০ কোটি। তার উপর যদি আইসিসি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ এর মত কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয় তাহলে তো কথাই নেই। ১০ সেকেন্ডের ছোট একটি বিজ্ঞাপন কিংবা পছন্দের খেলোয়াড়ের জার্সিতে ব্র্যান্ডের লোগো-স্পন্সর করার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানকে এনে দেয় কাঙ্ক্ষিত সেলস এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু।
এইবারের বিশ্বকাপে আইসিসি গ্লোবাল, অফিশিয়াল ও ক্যাটেগরি এই তিনটি ভাগে প্রায় ১৫টির মত ব্র্যান্ডের সাথে স্পন্সরশীপের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই স্পন্সরশীপের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলো পাবে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা। আজকের ভিডিওতে আমরা কথা বলব, কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রচার ও প্রসারের জন্য ক্রিকেটকে বেছে নেয় এবং কিভাবে তারা এইখান থেকে সুযোগ সুবিধা লাভ করছে।
১. টিভি সম্প্রচার, ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ইন্টিগ্রেশন
২০২৩ সাল পর্যন্ত আইসিসির সকল বড় বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সম্প্রচার সত্ত্ব কিনে নিয়েছে ডিজনি স্টার৷ এর ফলে তাদের ক্রীড়া চ্যানেল ‘স্টার স্পোর্টস’ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের মোট পঁয়তাল্লিশটি ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করবে সারা বিশ্বের ক্রিকেট ভক্তদের জন্য৷ যদি আপনার মোবাইলে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের সরাসরি সম্প্রচার দেখতে চান, তাহলে আপনাকে Disney+ Hot Star অ্যাপটি ব্যবহার করতে হবে।
আসন্ন আইসিসি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের অফিশিয়াল ব্রডকাস্টিং পার্টনার স্টার স্পোর্টস ইতিমধ্যে প্রতিযোগিতার টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের ৭০% বিক্রয় করে ফেলেছে। মাত্র ১০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনের জন্য চ্যানেলটি চার্জ করছে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা। বুঝতেই পারছেন ক্রিকেট স্পন্সরশীপ ঠিক কতটা লাভজনক ব্যবসা কোম্পানিগুলোর জন্য।
এছাড়া গ্লোবাল অ্যাসোসিয়েটস পার্টনারদের মধ্যে বাইজু’স (Byju’s) নামটি বেশ শুনতে পাওয়া যায়। ভারতীয় এই এড-টেক কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০১১ সালে । ক্রিকেটে স্পন্সরশীপের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটির ক্রীড়া জগতে প্রবেশ। বাইজু’স ২০১৯ সালে ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান স্পন্সর ছিলো। প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা করেছিল যে, গ্লোবাল স্পন্সর হতে আইসিসির সাথে আনুমানিক ১২০-১৩০ কোটি রুপির (US$16 মিলিয়ন) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গ্লোবাল পার্টনার হিসাবে, ইন-ভেন্যু সম্প্রচার এবং সমস্ত আইসিসি ইভেন্ট জুড়ে ডিজিটাল অধিকার সংরক্ষণ করে বাইজুস’। এছাড়া আইসিসি বিশ্বকাপের ইতিহাস, খেলার যাবতীয় টেকনিক নিয়ে বাইজু’স বিশেষ তথ্যচিত্র তৈরি করে যা দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্রোমোশনে ব্যবহার করা হয়।
২. আইসিসি’র লোগো ব্যবহারও
আইসিসির যেকোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলাকালীন সকল স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রমোশনের ক্ষেত্রে আইসিসির নাম ও লোগো ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। গ্লোবাল পার্টনার অব আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ, অফিশিয়াল পার্টনার অব আইসিসি, ক্যাটাগরি পার্টনার অব আইসিসি এরকম ভাবে তারা নিজেদের করতে উপস্থাপন করতে পারবে নিজ নিজ দর্শকদের কাছে।
৩. সাইনেজ এবং ইন-স্টেডিয়া ব্র্যান্ডিং
সাইনেজ এবং ইন-স্টেডিয়া ব্র্যান্ডিং অর্থাৎ স্টেডিয়ামের ভেতর স্পন্সররা তাদের ব্র্যান্ডের লোগো, ব্যানার, পোস্টার ইত্যাদি প্রদর্শন করতে পারে, খেলা শুরুর আগে পরে কিংবা বিরতিতে বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে। পাশাপাশি পণ্য প্রদর্শন করার অধিকারও তারা সংরক্ষণ করে। খেলার ফাঁকে ফাঁকে আমরা সেই সকল প্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলোকেই মাঠে সাজানো দেখতে পাই। ২০২১ সালের আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপে অফিশিয়াল পার্টনার ছিলো নিসান। এই জন্য প্রতিষ্ঠানটি বেছে নিয়েছিল তাদের ‘এসইউভি ম্যাগনাইট’ গাড়িটিকে। যার প্রেক্ষিতে ষাট হাজারটিরও বেশি বুকিং পড়েছিলো পণ্যটির। এছাড়াও নিসান ইন্ডিয়া টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ভার্চুয়াল ট্রফি ট্রিপ প্রচারের জন্য ক্রিকেট তারকা কপিল দেবের সাথে জুটি বেঁধেছে। এমন গ্লোবাল ইভেন্টে স্পন্সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিসান ইন্ডিয়ার মতো তাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পণ্যটি প্রদর্শন করে যাতে মার্কেটিং এর পাশাপাশি তাদের সেলস বৃদ্ধি পায়।
৪. টিকেট ও হসপিটাবিলিটি রাইটস
বিশ্বকাপ চলাকালীন সকল আইসিসি কর্মকর্তা-কর্মী, খেলোয়াড় ও দর্শকের ভ্রমণ এবং আবাসন ব্যবস্থা করার রাইটস পেয়ে থাকে কিছু প্রতিষ্ঠান। এমিরেটস সর্বপ্রথম ২০০২ সালে আইসিসির সাথে স্পন্সরশীপের চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রতিষ্ঠানটি আইসিসির সাথে তাদের সম্পর্ক আরোও পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে ২০০৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারিদের এলিট প্যানেলের আনুষ্ঠানিক স্পন্সর হয়। এর ফলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলাকালীন তাদের সকল প্রকার পরিবহনের ব্যবস্থা এমিরেটস করেছে। বিগত ২০১৬ সালে, আইসিসি এবং এমিরেটস আবারো তাদের চুক্তি নবায়ন করে যা ২০২৩ পর্যন্ত বহাল থাকবে। এই চুক্তির মাধ্যমে, এমিরেটস, আইসিসি আম্পায়ার এবং ম্যাচ রেফারিদের এলিট প্যানেল স্পন্সর করার পাশাপাশি আসন্ন টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ সহ সমস্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে আম্পায়ারদের পোশাকে ফ্লাই এমিরেটস লোগোটি বিশিষ্টভাবে প্রদর্শন করার সুযোগ পাবে।
আইসিসি ও Booking.com নামের একটি ভ্রমণ সংস্থা মার্চ ২০১৯ -এ পাঁচ বছরের চুক্তি ঘোষণা করেছে যেখানে প্রতিষ্ঠানটি সমস্ত আইসিসি ইভেন্টের অন্যতম হোটেল ও ভ্রমণ অংশীদার হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন যারা বিভিন্ন দেশ থেকে মাঠে খেলা দেখতে আসবেন, তাদের হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে সেখানে অবস্থান করা পর্যন্ত যাবতীয় সকল ব্যবস্থা Booking.com পালন করবে।
৫. কনজিউমার প্রমোশন রাইটস
আইসিসির যে কোন ইভেন্টকে পুঁজি করে নিজেদের বিশেষ ক্যাম্পেইন চালাতে পারে স্পন্সর করা অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় স্টার স্পোর্টস ‘মউকা মউকা’ নামে একটি মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালু করে যা আমরা ক্রিকেটপ্রেমীরা হয়তো কোনো দিনই ভুলতে পারবো না। এই ক্যাম্পেইনে ধূর্ত হাস্যরস এবং মনোরম কথোপকথনের মাধ্যমে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান টিমের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বিনোদনমূলকভাবে উপস্থাপন করা হয় যা আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কোকাকোলা ‘Turn up your game’ নামে একটি ক্যাম্পেইন নামিয়েছে যেখানে কোকাকোলার বোতলে লিখা কোডটি হোয়াটস অ্যাপ করলে সুযোগ ছিল আইসিসি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২২এর টিকিট জেতার। অন্যদিকে, আরেকটি স্পন্সরকারী প্রতিষ্ঠান ‘EatFit’ আইসিসি ইভেন্টকে সামনে রেখে তাদের প্রোডাক্ট লাইন-আপে বিশেষ পণ্য নিয়ে আসে, যেখানে কাস্টমাররা ক্রিকেট খেলোয়াড়দের মতোই স্বাস্থ্যকর খাবার অর্ডার করতে পারবে। এরকমভাবেই সকল পার্টনার সুযোগ পায় নিজেদের আলাদাভাবে প্রচারণা করার।
৬. প্রোডাক্ট এক্সক্লুসিভিটি রাইটস
প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানগুলোয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের একচেটিয়া প্রচার, প্রসার ও বিক্রয়ের সুযোগ পেয়ে থাকে। স্টেডিয়ামে কখনো কি দেখেছেন খেলা স্পন্সর করেছে কোকাকোলা কিন্তু পেপসির তাদের কোমল পানীয় বিক্রয় করছে বা প্রচারণা চালাচ্ছে? অবশ্যই না। প্রোডাক্ট এক্সক্লুসিভিটি রাইটস মূলত ব্র্যান্ডগুলোকে একচেটিয়া মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং করার সুযোগ দিয়ে থাকে। এতে করে প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় যেমন বৃদ্ধি পায় ঠিক তেমনি ব্র্যান্ড একই সাথে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে যা ব্র্যান্ডের ভ্যালু বাড়িয়ে দেয়। কোকা-কোলার পাশাপাশি বিরা নাইনটি ওয়ান (Bira91) এবং রয়েল স্ট্যাজ এবার বিশ্বকাপের অফিশিয়াল বেভারেজ পার্টনার।
সবশেষে, এসকল প্রতিষ্ঠানগুলো টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের স্পন্সর হয়ে দর্শকের আনন্দের উদযাপনের অংশ হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ায়। সকল অংশীদারি প্রতিষ্ঠানই চায় নিজ নিজ প্রচারণা ঠিকমতো পরিচালনা করতে, যাতে তারা বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে সহজেই পৌঁছাতে পারে।